দেশের অপরাপর অঞ্চলের মতো রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায়ও সকল শ্রেণীর কৃষক ও কৃষির সামগ্রীক উন্নয়নে নিয়োজিত রয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ১৯৯০ সনের ১লা জুলাই তারিখ হতে হস্তান্তরিত বিভাগ হিসেবে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জেলায় কৃষি উন্নয়নমূলক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় মোট ৬০,৩৭১ হেক্টর কৃষি জমির অধিকাংশ জমিতেই ধান, সব্জি, আলু, সরিষা, আঁখ, তরমুজ, বিলাতী ধনিয়া, মরিচ এসব আবাদ হয়ে থাকে। এছাড়া সমতল ভূমির সল্পতার কারণে পাহাড়ের বিভিন্ন ধাপে ফল, সব্জী ও মশলা জাতীয় ফসলও চাষ করা হয়ে থাকে। ফলের মধ্যে প্রধানতঃ কলা, আনারস, পেঁপে, পেয়ারা, আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, নারিকেল, লেবু, জলপাই, কাজুবাদাম প্রভৃতি। সব্জির মধ্যে কাঁকরোল, বরবটি, কচু, শশা, কুমড়া, করলা এবং মসলা জাতীয় ফসলের মধ্যে আদা, হলুদ,মরিচ,ইত্যাদির ফলন ভালো হয়। এছাড়া এখানে অপেক্ষাকৃত নিচু পাহাড়ে এবং পাহাড়ের ধাপে তুলা ও ভূট্টা বেশ ভালো জন্মে।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলায় ৫৩,৪৫০টি কৃষক পরিবারের মধ্যে ১৯৭২৭ জনই ক্ষুদ্র কৃষক, যাদের মাথাপিছু জমির পরিমাণ মাত্র ১.৫ একর থেকে ২.৪৯ একর। কৃষি উন্নয়ন কার্য্ক্রম পরিচালনার সুবিধার্থে সারা দেশের মতো এখানেও ১০ টি উপজেলা কৃষি অফিসের অধীনে মোট ১৬৫টি ব্লকে ১৬৫ জন ব্লক সুপারভাইজার কৃষকবৃন্দের সাথে প্রত্যক্ষভাবে কৃষি উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা ও তদারকীর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
জেলার খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি, পুষ্টি ঘাটতি পূরন এবং কৃষকবৃন্দের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত ও আধুনিক প্রযুক্তি প্রচলনে কৃষি সম্প্রসারম বিভাগ স্বকীয় অবদান রাখতে তৎপর রয়েছে। এ বিভাগ অধিক ফসল উৎপাদনে কৃষকবৃন্দকে আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ ও প্রয়োগে সরাসরি সহযোগীতাসহ উৎসাহিতকরণ, উৎপাদন উপকরণ সংগ্রহ, উৎপাদিত ফসল সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ এবং বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের অনুকূলে সার্বক্ষনিক পরামর্শ দিয়ে থাকে। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা কাছে ন্যস্ত হওয়ার পর ১৯৯০ সন হতে পরিষদের ব্যবস্থাপনা, নিয়ন্ত্রণ, পরামর্শ,নির্দেশনা এবং সরাসরি সহযোগীতা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কার্যক্রমকে অধিকতর বেগবান করে তুলেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্বঃ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের সকল কর্মকর্তা ও কর্মীবৃন্দ মুলতঃ অধিদপ্তরের একটি মিশন স্টেটমেন্টটি হলো- “কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের দায়িত্ব হলো সকল শ্রেণীর চাষীদেরকে তাদের চাহিদা ভিত্তিক ফলপ্রসূ ও কার্যকর সম্প্রসারণ সেবা প্রদান করা যাতে তাঁরা তাদের সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার স্থায়ী কৃষি ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কাজের সংক্ষিপ্ত ধরণঃ
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর পরিচালিত সকল কার্যক্রমকে বাস্তবমুখী ও গতিশীল করার লক্ষ্যে জাতীয়ভাবে প্রণীত হয়েছে।“ নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতি। নিজস্ব মিশন স্টেটমেন্টকে সামনে রেখে প্রনীত নতুন কৃষি সম্প্রসারণ নীতির আলোকে কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ কতৃর্ক সম্পাদিত কাজ গুলো হলো-
১) কৃষকদের আর্থ সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে সর্বশেষ গবেষনার ফলাফল এবং খামার ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক কলা কৌশল ও প্রযুক্তি কৃষকবৃন্দের কাছে পৌঁছে দেয়া।
২) ফসল উৎপাদনে উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতি গ্রহণে কৃষকবৃন্দকে সহায়তাসহ উদ্বুদ্ধ করা যাতে খামারের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জেলার চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি জাতীয় চাহিদা পূরণে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখা যায় এবং আমদানী নিম্নতম পর্যায়ে রাখা যায়।
৩) সর্বোচ্চ উৎপাদন কাজে কৃষকবৃন্দকে তাদের নিজস্ব চাহিদা, সম্পদ ও সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করা।
৪) প্রশিক্ষনের মাধ্যমে কৃষকবৃন্দকে আত্মনির্ভরশীল করার পাশাপাশি সহযোগী মনোভাবাপন্ন করে তোলা যাতে তাঁরা সম্মিলিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারে ; প্রয়োজনীয় সেবা প্রদান ও তথ্যাদির ব্যাপারে মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে যোগসূত্র স্থাপন ও ফলাফল কৃষকদের কাছে পৌঁছে দেয়া। অপরদিকে, জাতীয় পর্যায় থেকে প্রয়োজন রয়েছে কৃষকদের এমন সব সমস্যা, চাহিদা পূরণে মন্ত্রণালয়/ বিভাগের নজরে আনা।
৫)বিভিন্ন গবেষনা প্রতিষ্ঠান ও কৃষকবৃন্দের মধ্যে ঘনিষ্ট সংযোগ স্থাপন করা যাতে প্রযুক্তি বিস্তারের সাথে সাথে মাঠ পর্যায়ে সমস্যাদির আলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের গবেষনা প্রতিষ্ঠান সঠিক সমাধান দিতে পারে।
৬) কৃষিকর্মী বিশেষ করে মাঠ কর্মী এবং সকল স্তরের ও বয়সের কৃষকবৃন্দের কৃষি বিষয়ে শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা।
৭) কৃষকবৃন্দের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ঋন বিতরণ ও উপকরণ সরবরাহকারী সংস্থাসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও কৃষকদের সংযোগ মাধ্যম হিসেবে কাজ করা।
৮) জেলার ভৌগোলিক, স্থানীয় চাহিদা, সম্ভাব্যতা ও উপযোগীতার ভিত্তিতে ফসল উৎপাদনে কৃষকবৃন্দকে পরামর্শ, সহযোগীতা ও উদ্বুদ্ধ করা;
৯) পরিবেশ উন্নয়ন ও সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন।
সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনাঃ ন্যুনতম খরচে পরিবেশ সম্মতভাবে বালাই দমন ব্যবস্থাপনাকে নাঠ পর্যায়ে পরিচিতি ও প্রচলন জোরদারকরণের লক্ষ্যে ডিএই-ডানিডা এসপিপিএস প্রকল্পের আওতায় রাঙ্গামাটি সদর, কাউখালী ও কাপ্তাই উপজেলায় আইপিএম কৃষক মাঠ স্কুল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এছাড়া অপরাপর উপজেলাগুলোতেও আইপিএম প্রযুক্তি প্রয়োগের ব্যাপারে সযত্ন প্রচেষ্ঠা ও উদ্বুদ্ধকরণ কার্যক্রম চালু রয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে মাশরুম চাষ (১ম পর্যায়) প্রকল্পঃ পার্বত্য অঞ্চলে মাশরুম চাষ সম্প্রসারণ এবং খাদ্য হিসেবে মাশরুমকে জনপ্রিয় করা এবং জনগনের আর্থ সামাজিক অবস্থা উন্নয়নের লক্ষ্যে স্থাপিত মাশরুম চাষ প্রশিক্ষন ও বীজ প্যাকেট(স্পন) উৎপাদন কেন্দ্রের কার্যক্রম সাফল্যজনকভাবে চালু রয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে মাশরুম চাষ (১ম পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় এ যাবৎ ২১,৪৪৬ জন কৃষান-কৃষাণীকে হাতেকলমে প্রশিক্ষন প্রদান এবং জেলার ১০টি উপজেলায় সর্বোমোট ১,১১৪ টি প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ল্যাবরেটরিতে দৈনিক ৪০০-৫০০ মাশরুম বীজ প্যাকেট (স্পন) উৎপাদিত হচ্ছে।
কৃষি শিক্ষা বিস্তারের লক্ষ্যে কৃষি প্রশিক্ষন ইন্সটিটিউটঃ এলাকায় কৃষি শিক্ষা বিস্তার এবং এ বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভের সু্যোগ সৃষ্ঠির লক্ষ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০০ আসনবিশিষ্ঠ একটি কৃষি প্রশিক্ষন ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। “ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি কৃষি প্রশিক্ষায়তন স্থাপন প্রকল্পে”র আওতায় নির্মিত এই আবাসিক প্রশিক্ষায়তনে প্রতি ব্যাচে ২০০ জন ছাত্র এবং ১০০ জন ছাত্রী ৪ বছর মেয়াদী কৃষি ডিপ্লোমা কোর্স সম্পন্ন করার সুযোগ রয়েছে।
জেলা পরিষদের অর্থায়নে কৃষি উন্নয়নে বিশেষ কার্যক্রমঃ
ক) জেলার ১০টি উপজেলায় কৃষকদের মাঝে বিনামূল্যে চারা কলম বিতরণ।
খ) ভর্তুকী মূল্যে পাওয়ার পাম্প বিতরণ।
গ)ইদুঁর দমন কার্যক্রমে আওতায় বিনামূল্যে বিষটোপ বিতরণ।
ঘ) কৃষকদের মাঝে সুদমুক্ত ঋন বিতরণ( মিনি নার্সারী স্থাপন, মিশ্রুফল বাগান সৃজন ও অন্যান্য ফসল আবাদ ইত্যাদি।)
জনবলঃ রাঙ্গামাটি জেলার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ৪৪ জন কর্মকর্তা এবং ৩০০ জন কর্মচারীসহ সর্বোমোট ৩৪৪ জন কর্মরত আছেন।